শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
কুষ্টিয়ার মেয়ে অর্চণা বিশ্বাসের সাথে ঢাকার অনুপ বিশ্বাসের হিন্দু শাস্ত্রমতে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় নিয়ম ও প্রথা মেনে অর্চণা’র বাবা তন্ময় বিশ্বাস মেয়ের সুখের জন্য নগদ টাকা, ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও স্বর্ণালঙ্কার যৌতুক হিসেবে ছেলেকে প্রদান করেন। কিন্তু বিধিবাম! কয়েক বছর যেতে না যেতেই অনুপ বিশ্বাস প্রথম স্ত্রী অর্চণা বিশ্বাসকে কোনো কিছু না জানিয়ে কিংবা তার অনুমতি ব্যতিরেকে আরেকটি বিয়ে করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী রূপালী বিশ্বাসকে নিয়ে সুখে বসবাস শুরু করেন। এদিকে অর্চণা বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে স্বামী সংসার বিহীন নিদারুণ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মে তালাক দেয়ার বিধান না থাকায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্চণা বিশ্বাসকে অনুপ বিশ্বাসের স্ত্রী হয়েই নিয়মকানুন মেনে চলতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অর্চণা বিশ্বাসের ভরণপোষণ কে দেবে? কীভাবে কাটবে তার বাঁকি জীবন। যদি তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে তবে কেন অর্চণা বিশ্বাস পারবে না। এটি একটি মানবিক প্রশ্নের দাবীদার। অথচ হিন্দু আইনে একজন পুরুষ যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন কিন্তু স্ত্রী চাইলেও বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। ভরণপোষণের ক্ষেত্রে অবশ্য দুই ধর্মেই ভরণপোষণ সংক্রান্ত আইন রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্যমূলক আইন। মুসলিম আইনে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন এবং সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার তাঁদের রয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী হলেও ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগ মতবাদে হিন্দু নারীরা জীবনস্বত্বে এবং স্ত্রীর মালিকানাধীন এ দুভাবে উত্তরাধিকারী হতে পারেন। জীবনস্বত্বের ক্ষেত্রে এ সম্পত্তি কোনো নারী বেঁচে থাকা পর্যন্ত ভোগদখলের এখতিয়ার লাভ করেন। কিন্তু আইনগত কারণ ছাড়া এ সম্পত্তি তিনি হস্তান্তর করতে পারেন না। তার মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীর ওপর না বর্তিয়ে যার কাছ থেকে এটি পেয়েছিলেন তার নিকটবর্তী উত্তরাধিকারীর কাছে চলে যায়। তবে স্ত্রীর নিজস্ব কোনো সম্পত্তি হলে তা তার উত্তরাধিকারীর মধ্যে বর্তাতে পারে। তবে কোনো বিবাহিত হিন্দু নারীর যদি স্বামী মারা যায় তাহলে ওই বিধবা নারী ১৮৬৫ সালের হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন অনুযায়ী আবার বিয়ে করতে পারবেন এবং এ বিয়ের ফলে যদি কোনো সন্তান জন্মলাভ করে তবে সে সন্তান বৈধ সন্তান বলে বিবেচিত হবে। তবে বিধবার আবার বিয়ে হলে সে তার আগের স্বামীর কাছে আইনের দৃষ্টিতে মৃত বলে গণ্য হন এবং সে কারণে পুনর্বিবাহের ফলে তার সাবেক স্বামীর সম্পত্তির ওপর থেকে তিনি অধিকার হারান।
অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্ম মতে, বিয়ে সামাজিক বন্ধন। পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মতে বিয়ে একটি ধর্মীয় বিষয়। এ ছাড়া মুসলিম বিয়েতে স্ত্রীরা স্বামীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মোহরানা পায় এবং বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিন মাসের খোরপোষ (ভরণপোষণ) পায়; কিন্তু অন্য ধর্মে এ জাতীয় কোনো বিধান নেই। মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় বিয়ের কাবিননামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়। কিন্তু অন্য ধর্মের অনুসারী স্বামী যদি বিয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে তবে স্ত্রীর বিয়ে প্রমাণের কোনো উপায় থাকে না। তাই পারিবারিক বৈষম্য বন্ধে এখনই উপযুুক্ত সময় একটি ‘ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড’ প্রণয়নের। শুধু নারী নির্যাতন বন্ধ কিংবা নারী-পুরুষের সমানাধিকার বুলি ফোটালে হবে না, পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণের এ উদ্যোগকে আরো সক্রিয় করতে হবে। তবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, নারীর অধিকার হবে সমুন্নত।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮